ইবাদাত বনাম মু‘আমালাত

পোশাকী অনুকরণ বা সুন্নাতী পোশাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম বিভ্রান্তি ইবাদত ও মু‘আমালাতের পার্থক্য উল্টা করে দেখা। ঈমান, ইবাদত, হালাল উপার্জন, স্ত্রী ও সন্তান প্রতিপালন, সৃষ্টির অধিকার বা হক্কুল ইবাদ, হারাম ও কবীরা গোনাহ বর্জন, অমায়িক ব্যবহার, হিংসা ও অহংকার বর্জন, সৃষ্টির সেবা, সৎকাজে আদেশ, অন্যায় থেকে নিষেধ ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়াদিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুকরণ করার চেয়ে পোশাক-পরিচ্ছদ, খানাপিনা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর অনুকরণকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা।

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, মানুষের জীবনের কর্ম দু-প্রকার:

প্রথম প্রকারের কর্ম যা জাগতিক প্রয়োজনে সকল মানুষই করেন। ধার্মিক, অধার্মিক, আস্তিক, নাস্তিক, মুসলিম, অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকেই তা করতে হয়। সকল ধর্মের ও বিশ্বাসের মানুষই এগুলি করেন। সাধারণত ধর্মের পার্থক্যের কারণে এ সকল কর্মের মধ্যে পার্থক্য কম হয়। বরং ভৌগলিক ও পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে এসকল কর্মের মধ্যে পার্থক্য দেখা দেয়। এক যুগের একই ভৌগলিক পরিবেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সাধারণত একইরূপে এ সকল কাজ করেন। ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে কিছু খুটিনাটি পার্থক্য দেখা যায়। এসকল কর্মকে ‘মু‘আমালাত’ বা জাগতিক কর্ম বলা হয়।

পানাহার, পোশাক, বাড়িঘর, চাষাবাদ, চিকিৎসা ইত্যাদি এ জাতীয় কর্ম। পানাহার সকল ধর্মের মানুষই করেন। ধর্মহীন মানুষেও করেন। বাংলাদেশের মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই ভাত, মাছ, ডাল ইত্যাদি বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করে খান। আবার আরবের মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকলেই অন্য পদ্ধতিতে খাদ্য তৈরি ও গ্রহণ করেন। তবে ধর্মীয় বিধিবিধানের আলোকে কিছু পার্থক্য থাকে। পোশাক, চাষাবাদ ইত্যাদিরও একই অবস্থা।

এসকল কর্ম একজন মানুষ একান্ত জাগতিক প্রয়োজনে কোনোরূপ সাওয়াব বা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়াই করতে পারে। সেক্ষেত্রে তা একান্ত জাগতিক কর্ম বলে বিবেচিত হবে। আবার মুমিন এগুলি পালনের ক্ষেত্রে ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির’ নিয়ত করলে এবং এতদসংশ্লিষ্ট ইসলামী নির্দেশাবলি বা শিষ্টাচার পালন করলে তাতে সাওয়াব হবে এবং এ বিষয়ক ইসলামী রীতিনীতি পালন ‘ইবাদত’ বলে গণ্য হবে।

দ্বিতীয় প্রকারের কর্ম যা মানুষ শুধু ‘পারলৌকিক’ বা ‘ধর্মীয়’ উদ্দেশ্যে করে। এগুলিকে ইবাদত বলে। এ সকল কর্ম শুধু ‘ধার্মিক’ মানুষেরাই করেন, ‘অবিশ্বাসী মানুষেরা’ এ সকল কর্ম করেন না। এছাড়া এসকল কর্ম ‘ধর্মীয়’ নির্দেশনা নির্ভর। যুগ, পরিবেশ বা দেশের কারণে এগুলির মধ্যে পরিবর্তন হয় না। বরং ধর্মের কারণে এতে পার্থক্য দেখা দেয়। দেশ, যুগ ও পরিবেশ নির্বিশেষে সকল মুসলিম একই পদ্ধতিতে সালাত, সিয়াম, জানাযা, যিকির ইত্যাদি ইবাদত পালন করেন। অন্যান্য ধর্মেরও একই অবস্থা। এ সকল কর্ম একজন মানুষ একমাত্র ‘সাওয়াব’ বা আল্লাহর নৈকট্যের জন্যই করেন। জাগতিক প্রয়োজনে তা করেন না। করলে তা পাপে পরিণত হয়।

উপরের দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য দুটি বিষয় অনুধাবন করা:

প্রথম বিষয়টি এ অধ্যায়ের প্রথমে আলোচনা করা হয়েছে। সর্বযুগের সকল মানুষের ধর্ম হিসাবে ইসলামে ‘ইবাদত’ জাতীয় কর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হুবহু অনুকরণের উপরে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ‘মু‘আমালাত’ ও জাগতিক বিষয়ে যুগ, দেশ ও পরিবেশের কারণে বৈপরীত্য বা পার্থক্যের অবকাশ রাখা হয়েছে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সকল যুগের, সকল দেশের ও সকল সমাজের মুসলিম ঈমান, ইবাদত, হারাম ও কবীরা গোনাহ বর্জন, অমায়িক ব্যবহার, হিংসা ও অহংকার বর্জন, ইত্যাদি সকল ‘ইবাদতের’ ক্ষেত্রে হুবহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুকরণ করবেন। এ অনুকরণই তাঁদের নাজাতের অন্যতম মাধ্যম। পোশাক-পরিচ্ছদ, খানাপিনা, বাড়ি-ঘর, চাষাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে অনুকরণ সর্বদা সম্ভব নাও হতে পারে। বিষয়টিকে উল্টা করে নেওয়ার প্রবনতা খুবই আপত্তিকর।

দ্বিতীয়ত, আমরা উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারছি যে, ‘মু‘আমালাতের’ ক্ষেত্রে অনুকরণের বিচ্যুতি ক্ষমার্হ হলেও ইবাদতের ক্ষেত্রে ‘অনুকরণহীনতা’ বা ‘অনুকরণের বিচ্যুতি’ ক্ষমার্হ নয়। এ বিষয়টি আমাদেরকে দ্বিতীয় বিভ্রান্তি বুঝতে সাহায্য করবে।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ

বই: পোশাক পর্দা ও দেহ-সজ্জা

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *